মুরাদনগর প্রতিনিধি।।
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ভবানীপুর পশ্চিম মাঠে ড্রেজারের তান্ডব দিনদিন বেড়েই চলেছে। উপজেলা প্রশাসন মেশিন জব্দ বা বিনষ্ট করলেও অদৃশ্য ক্ষমতার খুটির জোরে ২৪ ঘন্টার মধ্যে আবার চালু হয়ে গেছে অবৈধ এই ড্রেজার। অনেকে মনে করছেন, প্রশাসন ড্রেজার ব্যবসায়ীদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। অথবা প্রশাসনের চোর-পুলিশ খেলার কারণে কোন ভাবেই অবৈধ ড্রেজার বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ দিকে কৃষি জমির মালিকরা বলেছেন, প্রশাসনের প্রতিবন্ধীতামূলক ভূমিকা ও ভূমিখেকো ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা না দেওয়ার কারণে স্থায়ী ভাবে ড্রেজার ব্যবসা বন্ধ হচ্ছে না। অপর দিকে ড্রেজার মালিক রাকিবুল হাসান নয়ন বলেন, আমরা সকলকে ম্যানেজ করেই ড্রেজার চালাই, কারো ক্ষমতা থাকলে ড্রেজার বন্ধ করে দেখুক, সকল গুমর ফাঁস করে দেব? কার বাবার ক্ষমতা আছে আমার ড্রেজার বন্ধ করার। অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার না পেয়ে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন করছে কৃষকরা।
আবার অনেক গ্রামে কৃষকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মুল্যে তাদের কাছ থেকে ৩ ফসলি কৃষি জমি ছিনিয়ে নিচ্ছে ড্রেজার ব্যবসায়ীরা। কিছু রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও এলাকার দালাল প্রকৃতির লোকদের ছত্রছায়ায় ভূমি খেকো চক্রটি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যার ফলে নিরীহ কৃষকরা বাধাঁ দিলেও হুমকি ধমকির শিকার হচ্ছে। অবৈধ ড্রেজারের দ্ব›েদ্ব এ উপজেলায় কয়েকটি খুনের ঘটনাও ঘটেছে। অপর দিকে বিনষ্ট করা ড্রেজার মেশিন ৪০ ফিট পানির নিচ থেকে তুলতে গিয়ে জাফর আলী (৫৪) নামের এক দিন মজুরের মৃত্যু হয়েছে। ড্রেজার গর্তে শিশুসহ প্রতিনিয়তই ঘটছে মৃত্যুর ঘটনা।
ভবানীপুর গ্রামের শতাধিক কৃষক অভিযোগ করে বলেন, ভবানীপুর গ্রামের রাকিবুল হাসান নয়ন, আক্তার হোসেন, করিমপুর গ্রামের ইকবাল হোসেন, বাখরনগর গ্রামের জসিম মেম্বার, স্বপন মিয়া, বিপ্লব, মোচাগড়া গ্রামের ফোরকান মিয়া ও মনির গং ড্রেজার দিয়ে যেভাবে ফসলি জমি ধ্বংস করছে তাতে কয়েক বছর পর ৩ গ্রামের কৃষকরা পথে বসতে হবে। নয়ন প্রথমে ৪০ শতক জমিতে ড্রেজার বসিয়ে এখন তার ডোবাটি ১২ একর নদীতে পরিনত হয়েছে। ফসলি জমি রক্ষা করার জন্য অনেকবার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছি। যতবার বন্ধ করতে যাই ততবারই রাজনৈতিক নেতাদেরকে তারা ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে। কিছুদিন আগে ড্রেজার বন্ধ রাখলে, মোচাগড়া গ্রামের ফোরকান কয়েক জনকে হুমকি দিয়ে বলেছে ‘তোদেরকে যেন আর ড্রেজারের পাড়ে না দেখি’ যদি দেখি খুন খারাপি হবে। তারা আরো বলেছে, সব জায়গা থেকে অনুমতি নিয়েই আমরা ড্রেজার চালাই। কেউ যদি উপজেলায় অভিযোগ করে তাদেরকেও মাশুল দিতে হবে। জীবনের ভয়ে এখন আর কেউ মুখ খুলতে রাজি নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নিরীহ কৃষক বলেন, নয়নের ড্রেজারের পাশেই আমার বাড়ি, আগে ড্রেজারটি শুধু দিনের বেলায় চলতো, এখন দিন রাত ২৪ ঘন্টা চালায়। প্রচন্ড শব্দে আমরা ঘুমাতে পারিনা। ভয়ে কিছু বলতেও পারছিনা। এরা টাকার জন্য মানুষ খুন করতেও দ্বিধা করবে না। প্রশাসন ড্রেজার মেমিন ও পাইপ যদি ভালো ভাবে ভাঙ্গতো বা বিনষ্ট করতো দ্বিতীয়বার কেউ এ ব্যবসা করার সাহস পেত না। প্রশাসনের সাথে লিয়াজো থাকায় ড্রেজার মেমিন ও পাইপ নামমাত্র ভাঙ্গে। যার ফলে আমাদের কৃষি জমি নদীতে পরিনত হচ্ছে।
যাত্রাপুর ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি সেলিম মুন্সী মেম্বার বলেন, আমাদের এমপি ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন সম্প্রতি মোচাগড়া হাইস্কুল মাঠের এক জনসভায় বলেছিল ‘কিছু অসাধু লোক কৃষি জমিতে ড্রেজিং করছে। যারা ড্রেজিং করছেন তারা এলাকার তথা দেশের শত্রæ। এই ড্রেজিং যে ভবিষ্যতে কি ভয়াবহ হবে, তা ১০ বছর পর উপলব্ধি করতে পারবেন। একটা কৃষি জমি তৈরী করতে শত বছর সময় লাগে। যারা ড্রেজিং করে মাটি বিক্রি করেন, তারা পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক এবং প্রশাসনকে অল্পসল্প টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে কৃষককের বিরাট ক্ষতি করছে, তাদের খপ্পড়ে পা দিবেন না। তিনি আরো বলেন, মাটি আমাদের মা, আপনারা আপনাদের মাকে বিক্রি করবেন না। আমরা এখন যে ফসল ফলাচ্ছি, ড্রেজিং করার কারণে ৫ বছর পরে তার অর্ধেক ফসলও পাবো না’। এমপির এ ধরণের বক্তব্যের পরও ড্রেজার ব্যবসায়ীরা অদৃশ্য কারণে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ড্রেজার মালিক রাকিবুল হাসান নয়ন আরো বলেন, টাকা খায় না কে? কত টাকা খায়না। আমরা সকল সেক্টরকে ফুট হিসেবে টাকা দিয়ে ড্রেজার চালাই। টাকা নেওয়ার পরও প্রশাসন ড্রেজার ভেঙ্গে দিয়ে আমাদের বিরাট ক্ষতি করছে। গত ৮/১০ বছর ধরে বিভিন্ন সেক্টরে কোটি কোটি টাকা ভাগ করে দিয়েছি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা পাভেল খান পাপ্পু বলেন, এ উপজেলার মতো এত ড্রেজার কোথাও চলতে দেখি নাই। অবৈধ ড্রেজার চালানো অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এই উপজেলায় কৃষি ফসল ফলানো ব্যাপক হারে হ্রাস পাবে। কৃষি প্রধান এ দেশকে বাঁচাতে অবৈধ ড্রেজারের লাগাম টেনে ধরতে হবে। না হলে ভবিষ্যত কৃষি জমির পরিনতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাসরিন সুলতানা নিপা বলেন, কোন ড্রেজার ব্যবসায়ী ও দালালদের সাথে আমাদের কোন যোগসাজস নেই। কৃষি জমি রক্ষার্থে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।
মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দীন ভূঞা জনি বলেন, আমি আর এসিল্যান্ড কয়েকবার ওই মাঠে অভিযান করেছি। সহসাই বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা করা হবে।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মু. খন্দকার মুশফিকুর রহমান বলেন, কৃষি জমি ধ্বংসকারী ড্রেজার বন্ধ করার জন্য ইউএনও, এসিল্যান্ড ও পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া আছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিএন/৯০